অর্ধশতাব্দী যাবৎ ক্ষতি করে চলে বডি স্প্রে!


CLs || শরীরকে দুর্গন্ধমুক্ত রাখতে অনেকেই বডি স্প্রে বা ডিওডোরেন্ট স্প্রে ব্যবহার করেন। বডি প্রে বোতলজাতে ব্যবহৃত হয় ফ্লোরিনভিত্তিক গ্যাস। এই গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাব প্রায় অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত থেকে যায়। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ফ্লোরিন মানবসভ্যতার জন্য একটি ক্ষতিকর গ্যাস। এর প্রভাবে কিছু গ্যাস তৈরি হয় যেগুলো মানুষকে অতিবেগুনি রশ্মির সম্মুখীন করে। ওই গ্যাসগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যও দায়ী।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রসায়নবিদ আন্দ্রেয়া স্টেলার মতে, হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন এই তিন নিষ্ক্রিয় গ্যাস ছাড়া প্রায় সব ধরনের পদার্থের সঙ্গেই বিক্রিয়া করে ফ্লোরিন। পুরোপুরি বিশুদ্ধ ফ্লোরিন দেখতে হলদেটে আর অবস্থা গ্যাসীয়। তবে দেখতে নির্দোষ মনে হলেও এটি এতটাই ভয়ংকর যে সাধারণত পরীক্ষাগারে এই গ্যাস সঞ্চিত রাখা হয় না। রসায়নবিদ স্টেলা বলেন, ফ্লোরিন গ্যাসের গন্ধ অনেকটাই ক্লোরিনের মতো। তবে কোনো স্থানে ফ্লোরিন গ্যাস দেখা গেছে মানুষের প্রথম কাজ হবে সেখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়া।
গবেষকরা জানান, ফ্লোরিন আয়ন মানুষের শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে
অসহ্য ব্যথা হয়। সবচেয়ে ভয়ের বিষয়টি হলো এই ব্যথা সারানো সম্ভব নয়, কারণ গ্যাসটি মানুষের শরীরের মধ্যে মিশে যায়। শরীরে প্রবেশের পর ফ্লোরিন গ্যাস শরীরের ক্যালসিয়াম নষ্ট করে দেয়। এই কারণে ফ্লোরিন কোনো মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যু হতে পারে।
হাইড্রোজেন ফ্লোরাইডের কিছু ব্যবহার আছে। কাঁচে নকশা তৈরি ও বৈদ্যুতিক সার্কিট তৈরিতে এটি ব্যবহার হয়। তবে এই এসিডের প্রভাবে কিছু রাসায়নিক বস্তু তৈরি হয় যেগুলো তেমন কোনো বিক্রিয়ায় অংশ নেয় না। গবেষক আন্দ্রেয়া স্টেলা বলেন, ফ্লোরিনকে কেন্দ্র করে যেসব রাসায়নিক যৌগ তৈরি হয় সেগুলোর বন্ধন হয় অত্যন্ত শক্তিশালী। যেমন টেফলনের কথাই ধরা যাক। কার্বন ও ফ্লোরিনের বন্ধনে তৈরি হয় টেফলন। প্লাস্টিকের মতো বস্তুটি রান্নার কড়াইয়েও ব্যবহৃত হয়। দাঁতের যতেœ ব্যবহৃত টুথপেস্টের মধ্যে সামান্য পরিমাণ ফ্লোরিন আয়ন থাকে। তবে মুখের মধ্যে এটি দাঁতকে রক্ষাকারী ক্যালসিয়াম ফ্লুরাইডের স্তর তৈরি করে।
ফ্লোরিনভিত্তিক সবচেয়ে ভয়ংকর গ্যাসটি হলো ক্লোরোফ্লুরো কার্বন বা সিএফসি। ১৯৮০ সালে প্রথম এই গ্যাসটির ক্ষতিকর দিক আবিষ্কৃত হয়। এই গ্যাস পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষাকারী ওজন স্তরের ক্ষতি করে। একবার ওজন স্তরের বড় ক্ষতি মানবসভ্যতা ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। ওজন স্তরের কারণে পৃথিবীতে ঢুকবে যে পরিমাণ অতিবেগুনি রশ্মি, তা মানুষ ত্বক পুড়িয়ে ক্যানসার তৈরি করার জন্য যথেষ্ট।
সিএফসি গ্যাস দ্রুত অবস্থার পরিবর্তন করে গ্যাস থেকে তরলে পরিণত হতে পারে। এই ধর্মের কারণে ফ্রিজ তৈরিতে এটি বিপুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে অ্যারোসল ও সুগন্ধি বোতলজাতেও এই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও ফ্রিজের জন্য রাসায়নিক বস্তু প্রস্তুতকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান হানিওয়েলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান শ্যাংকল্যান্ড বলেন, ১৯২০ সালের দিকে এসব যন্ত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক ছিল বেশ ক্ষতিকর।
এসব ছিল হাইড্রোকার্বনের মতো দাহ্য, অ্যামোনিয়ার মতো বিষাক্ত এবং মিথাইল ক্লোরাইডের মতো দাহ্য ও বিষাক্ত। ওই অবস্থার তুলনায় সিএফসি কম ক্ষতিকর হিসেবেই মনে করা হয়। গত শতাব্দীর আশির দশকে সিএফসির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে। ফ্লোরিনভিত্তিক ক্ষতিকর গ্যাসগুলো এফ-গ্যাস বলা হয়ে থাকে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য এফ-গ্যাসের ব্যবহার, পরিবেশে মিশে যাওয়ার সময়সীমা ও বৈশ্বিক উষ্ণতায় প্রভাব নিচে দেওয়া হলো।
সিএফসি-১১ গ্যাস পূর্বে ফ্রিজে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে তা নিষিদ্ধ। এই গ্যাস প্রকৃতিতে মিশে যেতে ৪৫ বছর সময় নেয়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ৪ হাজার ৬৮০ গুন। সিএফসি-১২ গ্যাস পূর্বে গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে ব্যবহার হলেও তা বর্তমানে নিষিদ্ধ। এই গ্যাস প্রকৃতিতে মিশে যেতে ১০০ বছর সময় নেয়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ১০ হাজার ৭২০ গুন।
সিএফসি-১১৩ গ্যাস পূর্বে ফ্রিজ ও যানবাহনে ব্যবহার হতো কিন্তু বর্তমানে নিষিদ্ধ। এই গ্যাস প্রকৃতিতে মিশে যেতে ৮৫ বছর সময় নেয়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ৬ হাজার ৩০ গুন। এইচসিএফসি-২২ গ্যাস ফ্রিজ ও যানবাহনে ব্যবহার হয়। এই গ্যাস প্রকৃতিতে মিশে যেতে এক হাজার ৭৮০ বছর সময় নেয়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ১২ গুন।
এইচএফসি-২৩ গ্যাস বৈদ্যুতিক সার্কিট, অগ্নি নির্বাপণ ও এইচসিএফসি-২২ তৈরিতে ব্যবহার হয় । এই গ্যাস প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২৭০ বছর সময় নেয়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ১৪ হাজার ৩১০ গুন। এইচএফসি-১৩৪এ গ্যাস ফ্রিজ, গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে ব্যবহার হয় । এই গ্যাস প্রকৃতিতে মিশে যেতে ১৪ বছর সময় নেয়। আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় এটি নেতিবাচক প্রভাব রাখে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ৪১০ গুন। এরই মধ্যে অনেক দেশেই সিএফসির ব্যবহার নিষিদ্ধ হচ্ছে। ইউরোপে এটি নিষিদ্ধ হচ্ছে ২০১৭ সালে। এ ছাড়া বিশ্বে অনেক দেশেই এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়'তে তারা তিনজন

দেবের সাথে কাজ করবেন মিষ্টি

ম্যাগাজিনে হট নার্গিস ফাখরি